করটিয়া থেকে কানাডার গল্প

করটিয়া থেকে কানাডার গল্প

১৯৯৫ সালে জানুয়ারিতে আমি যখন অবশেষে দু’বছরের সেশান জ্যাম কাটিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগ থেকে মাস্টার্স পর্বশেষ করলাম তখন সুনির্দিষ্টভাবে আমি ক্যারিয়ার নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ‘ফ্রিল্যান্সার হব।‘ আমার একমাত্র কোর কম্পিটেন্সি (খুঁটির জোর) খুঁজে বের করলাম – ইংরেজীর প্রতি আমার আগ্রহ এবং ইংরেজীতে দক্ষতা। প্রসঙ্গত বলা যায়, ১৯৮৬ সালে এসএসসিতে ইংরেজীতে আমার দুই পত্রেই ৭০ – ৭০ ছিল। সুতরাং ঠিক করলাম ইংরেজীতে ভর করেই বাংলাদেশে আমি আমার ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার দাঁড় করাব। ১৯৯৬ সালের ২২ মে, ভোরের কাগজে ২০ শব্দের একটি বিজ্ঞাপন দিলাম ঢাকা শহরের বিভিন্ন পেশাজীবিদের প্রাইভেট ওয়ান-টু-ওয়ানে বিজনেস ইংলিশ কোর্সের। প্রথম দিনই দুজন পেশাজীবি বাসায় চলে এলেন। তারপর আর কোন পেছন ফিরে দেখা নেই। সকাল-দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যা-রাত ঢাকার পেশাজীবি দিয়ে আমার বাসা ভরে গেল এক মাসের মাথায়। ভোরের কাগজ, প্রথম আলো, জনকণ্ঠ আমাকে নিয়ে নিয়মিত তাদের পড়ালেখা পাতায় ছোট খবর প্রকাশ করত। ঢাকা শহরের শখানেক পেশাজীবি প্রথম বছরেই আমার শিক্ষার্থী হয়ে গেল। চার-পাঁচ বছরের মাথায় সেটার সংখ্যা কয়েক হাজারে গিয়ে দাঁড়ালো। তখন বাধ্য হয়ে ছোট ছোট গ্রুপেও সেশন করাতে হত। আমি যে শুধু এই পেশাজীবিদের শেখাতাম তা নয়, আমিও এই আলোকিত মানুষগুলোর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতাম। ২০০০ সালের দিকে মনে হল, ঢাকার বিভিন্ন দূতাবাসগুলোয় পার্ট-টাইম করব। আমার যেহেতু মেজর দর্শনে এবং সাব-মেজর ইংরেজীতে, আমি ভাবলাম বিদেশ থেকে একটু পড়ে ইংরেজি আসলে ভাল হয়। ঠিক করলাম, ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজের অ্যাডভান্সড্ লেভেলে স্কলারশীপ নিয়ে ইংল্যান্ডে পড়ব। তের মাস লাগল এই স্কলারশীপ পেতে। ২০০১ সালে ইংল্যান্ডে গিয়ে এই পড়াশুনাটুকু করে দেশে ফিরে এলাম। ২০০৩-এ মনে হল শিক্ষকদের একটি সর্বজনস্বীকৃত কোর্স TESL করা দরকার। আবার লেগে থেকে একটি স্কলারশীপ ম্যানেজ করে ছ’মাস জুড়ে অনলাইনে একটি সার্টিফিকেট কোর্স করলাম। এটি শেষ করে মনে হল একটি টিচার্স ট্রেইনিং কোর্স ইংল্যান্ডে গিয়েও করে আসা দরকার। সুতরাং আরেকটি স্কলারশীপ বাগিয়ে ২০০৪-এ দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ডে গেলাম একুশ শতকের টিচিং এবং লার্নিং এর ওপর একটি প্রশিক্ষণ নিতে। ইংল্যান্ডে বসেই ঢাকার ড্যানিশ দূতাবাসে একটি খন্ডকালীন শিক্ষকতার সুযোগ পেলাম এবং তার পরের বছর আমেরিকান এম্ব্যাসিতে চুক্তিভিত্তিক ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ প্রশিক্ষক হিসেবে জয়েন করলাম যেটা কানাডা আসার আগ পর্যন্ত এক টানা বার বছর চলেছে। এর মাঝে কানাডিয়ান দূতাবাসসহ বিদেশি এনজিও, যেমন সেইভ দ্যা চিল্ড্রেন ইউকে, ডেনমার্ক, সুইডেন প্রকল্পগুলো, কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড, ICMAB, ICAB সহ দেশের নাম করা প্রথম শ্রেণির গোটা দশেক ব্যাংকে গত ২২ বছরে ১০,০০০ শিক্ষার্থী তথা ইএসএল লার্নারদের জন্য কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। জীবনে সাংবাদিকতা করার একটা ইচ্ছে ছিল, নাম করা একটি বেসরকারি চ্যানেলে চার বছরের বেশি নিউজ পড়েছি এবং ১০ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলা এবং ইংরেজী পত্রিকায় টুকটাক লেখালেখি করছি। মাঝে ২০০৯ এ মনে হল, নিজের গ্রামের জন্য কিছু করব। ঢাকার উত্তরার ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে দিয়ে গ্রামে দাদার বাড়িতে আত্মীয়দের কাছ থেকে আড়াই বিঘা মত জমি কিনে সেখানে ২০০৯ সালে একটি জামে মসজিদ এবং ২০১০ সালে একটি ইংলিশ ভার্সন স্কুল শুরু করলাম যাতে করে এই গ্রামে একটা দক্ষ মানবশক্তি তৈরি হয় এবং তারা বছর বিশেক পড়ে বাংলাদেশ সহ দুনিয়াকে জয় করতে পারে। আমার এই স্বপ্নের প্রজেক্টটি টাঙ্গাইল জেলার করটিয়া ইউনিয়নে অবস্থিত। আমার সব কাজই একটু হুট হাট, কিন্তু একবার কিছু শুরু করলে সেটায় সফলতা না পাওয়া পর্যন্ত আমি সেটা ছেড়ে আসি না। ২০১৬ এর গোঁড়ার দিকে হঠাত করে সিদ্ধান্ত নিলাম ইমিগ্র্যান্ট হয়ে কানাডা আসব, পৃথিবীর সেরা একটি দেশ থেকে নিজে কিছু শিখব আর আমার ২২ বছরের অভিজ্ঞতাকে এখানে শেয়ার করার চেষ্টা করব। যেই ভাবা সেই কাজ। প্রজেক্টে নেমে গেলাম এবং আট মাস পরে আমরা সদলবলে কানাডায়। কানাডায় এসেও যথারীতি একটি সংস্থায় ইএসএল টিচার হিসেবে পার্ট-টাইম এবং জিয়া’স ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টারের মাধ্যমে ফ্রি ল্যান্সিং শুরু করে দিলাম। পাশাপাশি দুটি কানাডিয়ান সার্টিফিকেট ও গ্রহণ করলাম। কানাডায় আমার মূল লক্ষ্য হচ্ছে কানাডা - বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করে বাংলাদেশের সাত বিভাগে আরো সাতটি স্কুল তৈরি করা। সেই লক্ষ্যে আমরা একটু একটু করে আগাচ্ছি। গতকালের একটি মজার ঘটনা দিয়ে আমার নিজের গল্প বলা পর্ব শেষ করছি। এডমনটনের বিখ্যাত নরকোয়েস্ট কলেজের চুক্তি ভিত্তিক ‘কারিকুলাম ডেভেলপার’ হবার অফার পেলাম। জীবনে আমি কোনদিন ৯টা ৫টা অফিস করিনি। গত ২৩ বছর ঢাকায়যেমন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ফ্রিল্যান্স ট্রেইনার কিংবা চুক্তি ভিত্তিক ট্রেইনার হিসেবে কাজকরেছি জিয়া’স ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টারের পক্ষ থেকে, কানাডাতেও তাই করছি এবং করবো। একটি কলেজের ESL টিচাররা যে কারিকুলামঅনুযায়ী ক্লাস করাবেন সেটা তৈরির একটি অংশে কাজ করতে পারব ভেবে ভাল লাগছে। সমস্ত প্রশংসা পরম করুণাময়ের। গতকাল ইন্টারভিউতে বাংলাদেশে আমার কাজের কথা বলছিলাম। স্বভাবতই আমাদের স্কুলের কথা চলে আসলো। যখন শুনলবাংলাদেশের গ্রাম পর্যায়ের এটা প্রথম ইংলিশ ভার্সন স্কুল এবং আমাদের টিচার-স্টুডেন্ট অনুপাত ১:১০ এবং সেইসাথে আমরা এখন ১০বছরে পা দিয়েছি, ইন্টারভিউয়ার বললেন, ‘জিয়া, তোমাদের স্কুলটা নিয়ে একটা লেসন লিখতে পার? এটা আমরা কারিকুলামে রাখবো। কানাডায় ESL টিচারদের স্বপ্ন আমরা ছড়িয়ে দিতে চাই।’ এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ে চোখে পানি চলে এল। মনে হল স্কুল প্রজেক্টটিকে বড় করে তোলার যে স্বপ্ন সেটা এভাবেই আস্তে আস্তে রূপ পেয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ্‌। নিজের সফলতার গল্প বললাম। আমি গ্রামের ছেলে। এই ছোট্ট সফলতার কাহিনীটুকু পড়ে সাতাশি হাজার গ্রামের কোন একটি ছেলে কিংবা মেয়ে খানিকটা অনুপ্রাণিত হলে, নিজের মধ্যে স্বপ্ন এবং জেদ তৈরি হলে ভাল লাগবে। লক্ষ্য করুন, আমি শুধু সফলতার অংশটুকু বলেছি। এর মাঝে অনেক শঙ্কা, অস্থিরতা, মন খারাপের অংশ ছিল। মনে রাখা দরকার, সব সফলতার গল্পই আসলে একটি কষ্টের গল্প। তাই আর ওই কষ্টের অংশটুকু বলিনি। মোদ্দা কথা হল স্বপ্ন দেখতে হবে, এক সেকেন্ডের জন্য লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যাওয়া যাবে না এবং লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত সমস্ত বিশ্বাস এবং শক্তি নিয়ে তার পেছনে লেগে থাকতে হবে।
রাশিফলে জেনে নিন কেমন যাবে আজকের দিনটি পূর্ববর্তী

রাশিফলে জেনে নিন কেমন যাবে আজকের দিনটি

২২০ বছর পর চিলেকোঠায় মিলল টিপু সুলতানের তলোয়ার পরবর্তী

২২০ বছর পর চিলেকোঠায় মিলল টিপু সুলতানের তলোয়ার

কমেন্ট