কৃষিজীবীদের মধ্যে দারিদ্র্য এখনো বেশি

কৃষিজীবীদের মধ্যে দারিদ্র্য এখনো বেশি

কয়েক দশকে বড় পরিবর্তন এসেছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। সবুজ বিপ্লবের সুবাদে কৃষি উৎপাদনও বেড়েছে কয়েক গুণ। তারপরও দেশের সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্যপীড়িত পেশাজীবী এখনো কৃষি খাতসংশ্লিষ্টরাই। খানা আয়-ব্যয় জরিপ (এইচআইইএস) ২০১৬ অনুযায়ী, সার্বিকভাবে দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের ১৮ দশমিক ২ শতাংশ কৃষি, বন ও মৎস্য চাষসংশ্লিষ্ট। এটি নিম্নতর দারিদ্র্যসীমার বিবেচনায়। আর উচ্চতর দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষ হিসাব করলে কৃষিজীবী আরো বেশি, ৩২ শতাংশ। গ্রামীণ অঞ্চলে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারীদের মধ্যে কৃষিতে সংশ্লিষ্ট রয়েছে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্যান্য পেশার তুলনায় কৃষিতে দারিদ্র্যের এ হার সর্বোচ্চ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত বছরগুলোয় দেশে শস্যের গড় দাম কমেছে। পাশাপাশি কৃষি উপকরণে সরকারি সহায়তা অপ্রতুল হওয়ায় শস্য উৎপাদনে কৃষকের ব্যয় বাড়ছে। সে অনুযায়ী উৎপাদিত ফসলের দাম না পাওয়ায় দারিদ্র্য থেকে বেরোতে পারছেন না তারা। এদের সিংহভাগই ক্ষুদ্র কৃষক। দেশের মোট কৃষকের ৭৫ শতাংশই প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র। এছাড়া মোট কৃষকের মাত্র ৮ শতাংশ বড় কৃষক ও ১৫ শতাংশ মাঝারি। সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের (ডিএএম) হিসাব বলছে, পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশে শস্যের গড় দাম কমেছে। ২০১০ সালে প্রতি টন শস্যের গড় দাম ছিল ১৯ হাজার ১৯১ টাকা। ২০১৪ সালে তা নেমে আসে ১৭ হাজার ৫০০ টাকায়। মধ্যবর্তী ২০১১ সালে ১৯ হাজার ৬১০ টাকা, ২০১২ সালে ১৭ হাজার ১৬৬ ও ২০১৩ সালে ১৭ হাজার ৭১০ টাকা প্রতি টন শস্যের গড় দাম ছিল। যদিও এ সময় কৃষকের শস্য উৎপাদন খরচ ক্রমাগত বেড়েছে। ফলে শস্য উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষকের অবস্থার আশানুরূপ উন্নতি হচ্ছে না। কৃষির উন্নতিতে ক্ষুদ্র কৃষকরাই মূল ভূমিকা রাখছেন। অথচ কৃষিতে সরকারি সুবিধার কাছে ভিড়তে পারছেন না তারা। কৃষি উপকরণসহ অর্থের জন্য ক্ষুদ্র কৃষককে তাই অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। বেশি দামে কিনতে হচ্ছে কৃষি উপকরণ। সার-বীজ থেকে শুরু করে ঋণসুবিধার সিংহভাগই যাচ্ছে বড় কৃষকের কাছে। যদিও দেশের মোট কৃষকের মধ্যে তাদের সংখ্যাই কম। তাদের বড় অংশ আবার সরাসরি আবাদের সঙ্গে যুক্ত নয়। সরকারি সুবিধা বণ্টনে এ ভারসাম্যহীনতা কৃষির প্রবৃদ্ধিতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ছয় বছরের ব্যবধানে কৃষির প্রবৃদ্ধি ৬ থেকে ১ শতাংশে নেমে এসেছে। ফসল উৎপাদন ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখার পরও দারিদ্র্য থেকে বেরোতে পারছেন না ক্ষুদ্র কৃষকরা। এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পৃথক তথ্য বলছে, গত ছয় বছরে প্রায় সব ধরনের পেশাজীবীর মধ্যে দারিদ্র্যের হার আগের তুলনায় কমলেও করণিক, সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী, সরকারি কর্মচারী ও কর্মহীন মানুষের দারিদ্র্য বেড়েছে। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো কার্যকর করে সরকার। সর্বোচ্চ ৭৮ হাজার (নির্ধারিত) এবং সর্বনিম্ন ৮ হাজার ২৫০ টাকা মূল বেতন ধরে অষ্টম বেতন কাঠামো অনুমোদন দেয়া হয়। এ কাঠামো অনুযায়ী, গ্রেডভেদে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বেড়েছে ৯১ থেকে ১০১ শতাংশ। এর আগে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সপ্তম বেতন কাঠামো ঘোষণা করা হয়েছিল ২০০৯ সালের ১ জুলাই। এতে সরকারি চাকরিজীবীদের সর্বোচ্চ ৪০ হাজার ও সর্বনিম্ন ৪ হাজার ১০০ টাকা মূল বেতন নির্ধারিত ছিল। সব স্তরের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন বাড়লেও করণিক, সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী ও কর্মচারীদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ছয় বছরের ব্যবধানে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এ শ্রেণীভুক্ত মানুষরা ২০১০ সালে নিম্নতর দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা জনগোষ্ঠীর ৮ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল। ২০১৬ সালে তারা হয়ে ওঠে নিম্নতর দারিদ্র্যসীমার নিচের জনগোষ্ঠীর ১১ দশমিক ৮ শতাংশ। আর উচ্চতর দারিদ্র্যসীমার নিচে এ শ্রেণীভুক্তরা ২০১৬ সালে ছিল ২৪ দশমিক ৪ আর ২০১০ সালে ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ। সংশ্লিষ্টদের মতে, বেতন বৃদ্ধির পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এসব মানুষের মধ্যে দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হতে পারে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও করপোরেশন মিলিয়ে বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা ১৩ লাখ ৮২ হাজারের বেশি। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা ১ লাখ ৪৮ হাজার ৮১৯ জন। আর দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা রয়েছেন ১ লাখ ৩৬ হাজার ৭৬৫ জন। এছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী রয়েছেন যথাক্রমে ৮ লাখ ৪০ হাজার ও ২ লাখ ৫৬ হাজার ৫৭২ জন। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, দেশের কৃষকের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত পরিবারের। ফলে তাদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক। কৃষকের দারিদ্র্য কমিয়ে আনতে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধির তথ্যে বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, বিষয়টি আমার কাছে ব্যাখ্যাতীত মনে হচ্ছে। কারণ সর্বশেষ বেতন কাঠামোয় তাদের বেতন যথেষ্ট বাড়ানো হয়েছে। তিনি আরো বলেন, এ ধরনের জরিপ পরিচালনায় উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় এখন বহুমাত্রিক মানদণ্ড বিবেচনা করা হয়। শুধু খাদ্যগ্রহণের ভিত্তিতে জরিপ হলে তাতে দারিদ্র্যের প্রকৃত চিত্র পাওয়া সম্ভব নয়। এ জরিপটিতে একাধিক অসঙ্গতি রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এইচআইইএসের তথ্যমতে, কৃষি খাতসংশ্লিষ্টদের পর সবচেয়ে বেশি দরিদ্র রয়েছেন কর্মহীনরা। দরিদ্রদের মধ্যে ১৪ দশমিক ৯ শতাংশের পরিবারের প্রধান কর্মহীন। ২০১০ সালে দরিদ্রদের মধ্যে কর্মহীন ছিল ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। দরিদ্রদের মধ্যে ১৪ শতাংশ সেবা খাতসংশ্লিষ্ট, ১১ দশমিক ৩ শতাংশ উৎপাদন ও পরিবহন খাতের, ৮ দশমিক ৩ শতাংশ বিক্রয়কর্মী, ৭ দশমিক ৬ শতাংশ পেশাজীবী ও প্রকৌশল খাতের এবং ২ দশমিক ৩ শতাংশ প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনাসংশ্লিষ্ট। এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, আমাদের দেশে বেশির ভাগই প্রান্তিক বা ক্ষুদ্র কৃষক। কৃষিপণ্য থেকে তাদের আয় অপ্রতুল। অকৃষি খাত থেকে আয়ের সুযোগও তাদের কম। ফলে এ পেশার মানুষের মধ্যে দারিদ্র্যের হার বেশি। এজন্য উৎপাদনশীল ও আয়ভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি কাজের সুযোগ না বাড়ালে ক্ষুদ্র কৃষকদের দারিদ্র্য কমানো সম্ভব হবে না। অন্যদিকে করণিক বা এ সংশ্লিষ্ট পেশায় যারা রয়েছেন, তাদের বেশির ভাগই শহর এলাকার অধিবাসী। বেতন-ভাতা বৃদ্ধি হলেও জীবনযাপনের ব্যয় সে তুলনায় বেড়েছে। সামগ্রিকভাবে দেশে দারিদ্র্য কমলেও কিছু বিশেষ শ্রেণীর জন্য লক্ষ্যভিত্তিক উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
নওগাঁ জেলা থেকে ১০ রোহিঙ্গা আটক পূর্ববর্তী

নওগাঁ জেলা থেকে ১০ রোহিঙ্গা আটক

ধানক্ষেতে গিয়ে মিশেছে পাকা সড়ক! পরবর্তী

ধানক্ষেতে গিয়ে মিশেছে পাকা সড়ক!

কমেন্ট