স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ৬৩% চা শ্রমিক

স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ৬৩% চা শ্রমিক

চা পাতার সঙ্গে সুমির সখ্য সেই শৈশবেই। বয়ঃসন্ধিতে পা রাখার আগেই শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন মৌলভীবাজারের আলীনগর চা বাগানে। বয়স ৩৫ও হয়নি। এর মধ্যেই ঘাড় ও পিঠে বাসা বেঁধেছে অসহনীয় ব্যথা। শারীরিক এ সমস্যা নিয়েই প্রত্যহ চা পাতা সংগ্রহ করে চলেছেন সুমি। তবে ব্যথাটা তীব্রভাবে জানান দিলে শরণাপন্ন হন বাগানের মেডিকেল কেন্দ্রের। যদিও চিকিৎসকের দেখা পান কদাচিৎ। একজন কম্পাউন্ডার থাকলেও সবসময় পাওয়া যায় না তাকে। বাধ্য হয়ে চিকিৎসা ছাড়াই রোগ পুষে রাখতে হচ্ছে এ চা শ্রমিককে। মৌলভীবাজারেরই কমলগঞ্জ শমশেরনগরের ফাঁড়ি দেওছড়া চা বাগানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন শিউ প্রসাদ, শংকর, রবিদাসরা। ভাঙাচোরা জরাজীর্ণ খুপরিতেই বছরের পর বছর পরিবার নিয়ে বাস করছেন তারা। মজুরি হিসেবে দৈনিক যে ৮৫ টাকা পান, তা দিয়ে কোনোমতে খাওয়া-পরা চললেও পুষ্টির ঘাটতি থেকেই যায়। রোগব্যাধি হলেও ওষুধপথ্য কেনার সামর্থ্য থাকে না। বাধ্য হয়ে রোগব্যাধিকে সঙ্গী করেই বেঁচে থাকতে হয়। কী ধরনের পরিবেশে দেশের চা শ্রমিকদের কাজ করতে হয়, তা নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। ‘আ স্টাডি রিপোর্ট অন ওয়ার্কিং কন্ডিশনস অব টি প্লান্টেশন ওয়ার্কার্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের চা শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের স্বাস্থ্যনিরাপত্তার বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত। চা শ্রমিকদের ৬৩ শতাংশই রয়েছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। দেশের ১০টি চা বাগানের ২৯৭ জন শ্রমিকের তথ্যের ভিত্তিতে গবেষণাটি করা হয়েছে। এছাড়া ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন করা হয়েছে ছয়টি। সেখানে ছিলেন পঞ্চায়েত, শ্রমিক, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, চা বাগানের ব্যবস্থাপক ও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিরাও। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করলেও ঝড়-বৃষ্টিতে আশ্রয় নেয়ার মতো ব্যবস্থা নেই কর্মক্ষেত্রের পাশে। বিশ্রামও সেভাবে পান না শ্রমিকরা। অভাব রয়েছে নিরাপত্তা কিটস, টয়লেট সুবিধার। কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ছাড়াও পুষ্টিকর খাদ্য না পাওয়ার কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে চা শ্রমিকদের মধ্যে। স্বাস্থ্যের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব টের পান ৭৫ শতাংশের বেশি চা শ্রমিক। ৮৪ শতাংশ চা শ্রমিক ভোগেন মাথাব্যথায়। মাংসপেশির ব্যথা নিয়েও কাজ করেন ৭৪ শতাংশ শ্রমিক। আর পিঠের ব্যথায় আক্রান্ত চা শ্রমিকদের ৭২ শতাংশ। এসব রোগে ভুগলেও চা শ্রমিকদের জন্য চিকিৎসা সুবিধা বেশ দুর্বল। আইএলও তাদের গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে বছরখানেক আগে। গবেষণাটি পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. ফয়সল আহম্মদ। গবেষণার বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, চা শ্রমিকরা একটি বৃত্তের মধ্যে থেকেই জীবন অতিবাহিত করছেন। দারিদ্র্য দিয়ে তাদের জীবন শুরু হচ্ছে। শেষও হচ্ছে দারিদ্র্য দিয়েই। মালিকদের হাস্যকর উদ্যোগের কারণে চা শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সরকারের অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিও সেখানে পৌঁছাচ্ছে না। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের খাদ্যসহায়তা কর্মসূচিগুলো থেকেও পর্যাপ্ত সহায়তা পাচ্ছেন না এসব শ্রমিক। আবার কাজেরও সুষ্ঠু পরিবেশ পাচ্ছেন না তারা। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে। জীবনধারণের প্রয়োজন মেটাতে ন্যূনতম আয়ের নিশ্চয়তা ও বাগান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শ্রমিকের প্রাতিষ্ঠানিক চুক্তি ছাড়া এ অবস্থায় পরিবর্তন আসবে না। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, চা শ্রমিকরা প্রতিদিন গড়ে ৮৫ টাকা মজুরি প্রাপ্য হলেও পাচ্ছেন গড়ে ৬৯ টাকা। দেশের এ মজুরি হার ভারতের চেয়েও অনেক কম। নির্দিষ্ট ওজনের মধ্যেই চা তুলতে পারলে কেবল ৮৫ টাকা পেয়ে থাকেন। এর চেয়ে কম তুললে হাজিরা থেকে কাটা পড়ে নির্দিষ্ট হারে। ৫৫ শতাংশ চা শ্রমিকের মাসিক আয় ১ হাজার ৫০১ টাকা। অন্যদিকে ৩৩ শতাংশ শ্রমিকের আয় ১ হাজার ৫০০ টাকা। ৩ হাজার টাকা আয় করেন মাত্র ২ শতাংশ চা শ্রমিক। নিয়োগ প্রক্রিয়ার কারণে মজুরিবৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তারা। কেননা ৯৩ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিয়োগ পাচ্ছেন। চা শ্রমিকের ৬৪ শতাংশই নারী। ৯০ শতাংশ শ্রমিকই তাদের সুপারভাইজর দ্বারা হয়রানির শিকার হন। তবে চা শ্রমিকদের জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করা হচ্ছে বলে দাবি করেন চা বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা সংসদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ আলম। তিনি বলেন, চা শ্রমিকদের আমরা নিজেদের মানুষই মনে করছি। এজন্য সরকারের বেঁধে দেয়া ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন ছাড়াও রেশন ও স্বাস্থ্য সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া চা বাগানের নারীদের যে ধরনের মাতৃত্বকালীন সুবিধা দেয়া হচ্ছে, তা অন্যান্য শ্রমঘন শিল্পের তুলনায় অনেক ভালো। পাশাপাশি প্রতি বছরই তাদের মজুরি বাড়ানো হচ্ছে। চা শ্রমিকের আবাসও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ৯১ শতাংশ শ্রমিক মালিকের দেয়া ব্যবস্থাপনায় থাকলেও আকার, সুযোগ-সুবিধা, পরিমাণ ও জায়গা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেন ৫৬ শতাংশ শ্রমিক। কর্মপরিবেশকে চা শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকির অন্যতম কারণ বলে জানান সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. হিমাংশু লাল রায়। তিনি বলেন, চা শ্রমিকদের দীর্ঘসময় ধরে কাজ করতে হয়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের পাশাপাশি স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানির সুযোগ থেকেও বঞ্চিত তারা। এছাড়া স্বল্পমজুরির কারণে এদের বেশির ভাগই অপুষ্টির শিকার। ফলে বেশির ভাগ চা শ্রমিকই নানা রোগে ভোগেন। বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্যানুসারে, দেশে এখন চা বাগানের সংখ্যা ১৬৪, যেখানে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার ৭৫৭ হেক্টর জমিতে চা আবাদ করা হয়। এসব বাগানে নিবন্ধিত চা শ্রমিকের সংখ্যা ৮৯ হাজার ৮১২। কিন্তু পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে চা শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় সাড়ে তিন লাখ শ্রমিক। নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী প্রায় ১২ লাখ, যার সিংহভাগই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ। সাঁওতাল, ওঁরাও, মোন্ডা, দেশওয়ারী, মোরা, উড়িয়া, খাড়িয়া, রাজবংশী প্রভৃতি সম্প্রদায়ের চা শ্রমিকরা বাস করেন এখানে। কয়েক বছর ধরেই ছয় থেকে সাড়ে ছয় কোটি কেজি চা উৎপাদন করছেন বাংলাদেশের শ্রমিকরা। বিশ্ববাজারে প্রায় ২ শতাংশ চায়ের অংশীদার বাংলাদেশ। যদিও চা শ্রমিকরা থাকছেন বঞ্চিতই। চা বাগানগুলোয় প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের উপযোগী শিশুরও অর্ধেকই রয়েছে শিক্ষার বাইরে। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী এ প্রসঙ্গে বলেন, বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত চা শ্রমিকরা। ৮৫ টাকা মজুরিতে কারো পক্ষেই সুস্থভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। মালিকরা অনেক বেশি লাভবান হলেও শ্রমিকদের বঞ্চিত করা হচ্ছে দিনের পর দিন। সময় উপযোগী ও বাজারদরের সঙ্গে খাপ খাইয়ে সবার সম্মতিক্রমে একটা মজুরি নির্ধারণ এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি।
সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে পেঁয়াজের বাজার পূর্ববর্তী

সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে পেঁয়াজের বাজার

২০১৮ সালে দেশের সব তফসিলি ব্যাংক ২৪ দিন বন্ধ থাকবে পরবর্তী

২০১৮ সালে দেশের সব তফসিলি ব্যাংক ২৪ দিন বন্ধ থাকবে

কমেন্ট