কলেজশিক্ষার্থী মিতার মৃত্যু নিয়ে রহস্য কাটছে না, খোঁজ নেই বন্ধু অজয়ের

কলেজশিক্ষার্থী মিতার মৃত্যু নিয়ে রহস্য কাটছে না, খোঁজ নেই বন্ধু অজয়ের

ফেনীতে কলেজশিক্ষার্থীর মিতা রানী নাথের মৃত্যু কীভাবে হয়েছে এ রহস্য এখনও উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ।  মিতার মৃত্যুর ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও রহস্য ঘেরা থাকছে এ মৃত্যু। এমনকি তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা স্বামী পরিচয়ে বন্ধু অজয় সাহারও (২১) খোঁজ নেই।

গত ১৭ মে রাত সাড়ে ৯টার দিকে গুরুতর আহত অবস্থায় মিতাকে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান অজয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক ঘণ্টা পর মারা যান তিনি।

নিহতের পরিবার ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, শহরের সহদেবপুর এলাকার বাসিন্দা তপন লাল নাথের মেয়ে মিতা ফুলগাজী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী। গত ১৭ মে বিকালে প্রাইভেট পড়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হন তিনি। পরে রাত ৯টা ১২ মিনিটে অজয় মিতার বড় বোন অপর্ণাকে ফোন করে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কথা জানান। একইসঙ্গে তাকে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে আসার কথাও বলেন।  মিতার মৃত্যুর পরপরই সটকে পড়েন অজয়।

ফেনী জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, সেদিন রাতে অজয়সহ আরও দুজন মিতাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। তখন অজয় চিকিৎসককে মিতার স্বামী পরিচয় দিয়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার কথা জানান।

নিহতের বড় বোন অপর্ণা বলেন, ‘অজয়ের সঙ্গে মিতার বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। সেদিন রাত ৮টা ৫২ মিনিটে মিতার সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়। তখন সে দ্রুত বাসায় ফিরছে বলে বাবাকে জানাতে বলেছিল। তারপর ৯টা ১২ মিনিটে অজয়ের নম্বর থেকে কল দিয়ে দুর্ঘটনার কথা জানানো হয়। খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক আমার ভাইকে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলাম। সেখানে নিশাত নামে এক ব্যক্তি, তার স্ত্রীসহ অজয় ছিল। একপর্যায়ে তারা আমার বোনকে হাসপাতালে রেখে সটকে পড়েন। আমরা চাই, এ ঘটনার সকল রহস্য বের হোক। সেদিন যদি দুর্ঘটনা হয়েও থাকে তাহলে দুর্ঘটনাস্থল কোথায় বা কীভাবে হয়েছে তা আমরা জানতে চাই।  অজয় যদি কোনো অপরাধ না করে থাকে তাহলে কেন পালিয়ে গেল।’

এদিকে মিতার মৃত্যুর ঘটনায় তার বাবা তপন লাল নাথ বাদী হয়ে ফেনী মডেল থানায় একটি মামলা করেছেন। এতে ফেনী পৌরসভার পশ্চিম মধুপুর এলাকার জয়ন্ত সাহার ছেলে ও ফেনী সরকারি কলেজের ডিগ্রি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী অজয় সাহাকে আসামি করা হয়েছে। মামলার এজাহারে শহরতলীর লালপোলে দুর্ঘটনা ঘটে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

মামলার আবেদনে বলা হয়, অজয় সাহা মিতাকে নিয়ে মহাসড়কের লালপোল এলাকায় বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালাচ্ছিল। ওই সময় মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে মারা যান মিতা। এজন্য তাকে আসামি করে সড়ক পরিবহন আইনের ৯৮/১০৫ ধারায় এ মামলা করা হয়েছে।

এজাহারে উল্লিখিত ঘটনাস্থল ও দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে লালপোল ও খাইয়ারা এলাকার একাধিক স্থানীয় বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তবে কেউই এ ধরণের দুর্ঘটনার তথ্য নিশ্চিত করতে পারেনি। লালপোল এলাকার ব্যবসায়ী কামাল উদ্দিন বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত এখানে কাজ করি। সেদিন আশপাশে এমন কোনো দুর্ঘটনার তথ্য পায়নি। এছাড়াও এ সড়কে যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা শুনতে পাই। সেদিন এমন কিছু কারও কাছে শুনিনি।’

খাইয়ারা এলাকার বাসিন্দা রিফাত হোসেন বলেন, ‘সেদিন আমাদের এলাকায় এমন কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি দেখে এলাকায় খোঁজখবর নিয়েছি। কিন্তু কেউই এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য জানাতে পারেনি।’

ছেলের লাপাত্তা ও মিতার মৃত্যু নিয়ে কথা হয় অজয়ের বাবা ফেনী বড় বাজারের চাউল ব্যবসায়ী জয়ন্ত সাহার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘১৮ মে থেকে অজয়ের ডিগ্রি প্রথম বর্ষের পরীক্ষা ছিল। শনিবার বিকালে কিছুক্ষণের জন্য বাহিরে যাওয়ার কথা বলে সে দোকান থেকে বের হয়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে বাসায় ফিরে এক মেয়ে তার মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানায়। তখন তার সঙ্গে নিশাত ছিল। পরবর্তী রাতে অজয় বাসা থেকে বের হয়ে যায়। তারপর এখনও আমাদের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। ওর ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরও বন্ধ রয়েছে।’

অজয়ের চাচা প্রশান্ত সাহা বলেন, ‘আমরা দুই ভাই শারীরিকভাবে খুবই অসুস্থ। অজয় আমাদের চালের দোকানে বসত। এ সম্পর্কের বিষয়েও আমরা জানতাম না। কীভাবে কী হয়ে গেছে, কিছুই বুঝতে পারছি না।’

এদিকে, মিতার মৃত্যুর ঘটনার পর থেকে আলোচনায় আসে অভিযুক্ত অজয়ের সঙ্গে সেদিন ফেনী জেনারেল হাসপাতালে যাওয়া অন্য দুজন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, অজয়ের সঙ্গে সেদিন হাসপাতালে যাওয়া যুবকের নাম নিশাত চন্দ্র দাস। তিনি শহরের মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনে একটি বাসায় পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। অজয়ের পার্শ্ববর্তী বাসা ও দোকানের সুবাদে তাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। একই সময় হাসপাতালে ছিলেন নিশাতের স্ত্রীও।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিশাত চন্দ্র বলেন, ‘অজয় ফোন দিয়ে দুর্ঘটনার কথা বললে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে আমি হাসপাতালে যায়। তখন হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে অজয় একটি পিকআপ ভ্যানে মিতাকে নিয়ে অবস্থান করছিল। পরে হাসপাতালের দায়িত্বরতদের সহযোগিতায় মিতাকে নামিয়ে জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়। একপর্যায়ে মিতার ভাইও সেখানে উপস্থিত হন। তারপর তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে চিকিৎসকের পরামর্শে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে হাসপাতালের নতুন ভবনের চতুর্থ তলায় নিয়ে যায়। এ সময়ে সার্বক্ষণিক আমার স্ত্রী মিতার পাশে থেকে সহযোগিতা করেছে। তখনও মিতা কথা বলেছিল এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথার কথা জানায়। এক সময় আমার ব্যস্ততার কারণে সেখান থেকে অজয়সহ বাসায় ফিরে আসি।’

তিনি আরও বলেন, ‘অজয়ের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলেও মিতার বিষয়ে তেমন কিছু জানি না। তাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক রয়েছে বলে জানতাম। সেদিন রাত থেকে অজয়ের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ নেই। এখানে আমার বা স্ত্রীর কোনো কিছুই নেই। শুধু খবর পেয়ে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে স্বামী-স্ত্রী হাসপাতালে গিয়েছিলাম।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, অজয়ের নিজের কোনো মোটরসাইকেল ছিল না। সেদিন বিকালে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে নিশাত চন্দ্রের মোটরসাইকেল নিয়ে যায় অজয়। ঘটনার পর মোটরসাইকেলটি অক্ষত অবস্থায় বর্তমানে নিশাতের কাছেই রয়েছে। জানতে চাইলে নিশাত চন্দ্র দাস বলেন, ‘শখের বসে আমি মোটরসাইকেল কিনেছিলাম। কিন্তু অসুস্থতার জন্য মোটরসাইকেল চালানো হয় না। গাড়ির একটি চাবি আমার বাড়িওয়ালার ছেলের কাছে থাকতো। শনিবার তার কাছ থেকেই অজয় ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে মোটরসাইকেল নিয়ে যায়। সেদিন হাসপাতাল থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে এসেছি। গাড়ির সবকিছু আগের মতোই রয়েছে। কোনো ধরণের দাগ বা ক্ষতিও হয়নি।’


মিতার মৃত্যু নিয়ে মহিপাল হাইওয়ে থানার ওসি হারুন উর রশিদ বলেন, ‘এ ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে। অভিযুক্ত যুবককে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মেঘনা নদীতে ৩ কোটি টাকার চিংড়ি রেণু জব্দ করে ডাকাতিয়ায় অবমুক্ত পরবর্তী

মেঘনা নদীতে ৩ কোটি টাকার চিংড়ি রেণু জব্দ করে ডাকাতিয়ায় অবমুক্ত

কমেন্ট