
তাদের কেউ কানে শুনতে পান না, কারো হাতের আঙুল নেই, কারও নেই চুল। আবার কারও আঙুল বাঁকা হয়ে গেছে, কারও মুখমণ্ডল নেই আগের মতো। এরা সবাই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরে সংঘটিত সহিংসতার শিকার। পেট্রোল বোমার আঘাতে এখন তারা যাপন করছেন এক অস্বাভাবিক জীবন।
এমনই কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় । তারা বলেন, স্বাভাবিক নেই তারা। সাধারণ মানুষ হয়ে এবং রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না থেকেও তারা সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর দায় রাজনীতিবিদদের। দেশের নোংরা রাজনীতির বলি হয়েছেন তারা।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের নির্বাচনের আগে ও পরের বিভিন্ন সহিংসতার শিকার কয়েকজনের সঙ্গে। তাদেরই একজন নোয়াখালির হাতিয়া উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়ন মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা শামসুন্নাহার বেগম। এই শিক্ষিকা একা নন, তার দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের আগে পেট্রোল বোমায় আহত হন।
শামসুন্নাহার বেগম বলেন, ‘২০১৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রথম হরতাল অবরোধে আমি, ছেলে তানজিমুল হক অয়ন আর মেয়ে সালমা আনিকা এই সহিংসতার শিকার হই। আমি আর আমার ছেলে ৫২ দিন বার্ন ইউনিটে ভর্তি ছিলাম। এখনও কিছু দিন পরপরই চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। আমরা মানসিকভাবেও আঘাত পেয়েছিলাম। আমার মতো অনেকেই আছেন। তাদের অনেককেই ঢাকার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটেও পাঠানো হয়। আমরা অনেক চিকিৎসা নিয়েছি। সেই স্মৃতি ভুলে থাকতে চাই, কিন্তু পারি না। আমাদের জন্য ওই রাত ছিল ভয়াবহ, কালো রাত।’
শামসুন্নাহার বেগম বলেন, ‘নোংরা রাজনীতিতে শুধু আমরা তিনজনই পুড়লাম না, পুড়লো আমার গোটা সংসার। মেয়েকে নিয়ে শান্তিনগরে চিকিৎসকের কাছ থেকে ফেরার পথে কাজীপাড়ায় আমরা সিএনজিতে এই পেট্রোল হামলার শিকার হই। এই পেট্রোলের আগুন আমাদেরকে একেবারে শেষ করে দিয়েছে। আমার দুই হাত, পুরো মুখ, মেয়ের চুল আর কান পুড়ে যায়। মেয়ে এখন মোটামুটি ভালো আছে। তবে ওর মাথার চুল একেবারেই ফেলে দিতে হয়েছে। কিন্তু আমার ছেলেটার সুস্থ হতে আরও সময় লাগবে। ওর এক হাতের আঙুল বাঁকা হয়ে গেছে, শ্বাসনালীতে সমস্যা ছিল। ওর আরও সার্জারি লাগবে।’
অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক আর বার্নের কারণে রক্তে সমস্যা দেখা দিয়েছে শামসুন্নাহারের। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট আর পিজি হাসপাতালে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি) তার চিকিৎসা চলছে। একরাশ হতাশা নিয়ে তিনি বলেন, ‘পেট্রোল বোমা আমাকে সারাজীবনের জন্য অসুস্থ করে দিয়েছে।’
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পেট্রোল বোমা সন্ত্রাসের আরেক শিকার রাজশাহীর ট্রাকচালক সিদ্দিক নিজের হাতে ভাত খেতে পারেন না। কানেও শুনতে পান না। পেট্রোল বোমার শিকার হওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সিদ্দিক বলেন, ‘সেদিন মসুর ডাল নিয়ে রাজশাহী থেকে ঢাকা যাচ্ছিলাম। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে সিরাজগঞ্জের কড্ডার মোড় এলাকায় ট্রাকে পেট্রোল বোমা মারে। পুরো শরীর আগুন লেগে যায়। গায়ের সব কাপড় ফেলে কোনোরকমে বেঁচে যাই। কিন্তু ততক্ষণে হাত, কান পুড়ে গেছে।’
সিরাজগঞ্জে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয় সিদ্দিককে। তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকায়। রাত আড়াইটার দিকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। সেখানে আড়াই মাস চিকিৎসা চলে তার।
নিজের বর্তমান শারীরিক অবস্থার কথা জানিয়ে সিদ্দিক বলেন, ‘কান ছোট হয়ে গেছে, এখন কানে শুনতে পাই না। নিজের হাতে ভাত খেতে পারি না। ডান হাতে আগের মতো শক্তি পাই না। একটা মুদি দোকান দিয়ে কোনোরকমে বেঁচে আছি।’
শুধু শামসুন্নাহারসহ তার পরিবার কিংবা সিদ্দিকই নন, খালেদ, আবুবকর, আরমান, রাজন, আব্দুর রশীদ— সবারই অবস্থাই এক। তাদের কারও হাত, কারও হাতের আঙুল, কারও কান আগুনে পুড়ে গেছে। কেউ কেউ বেঁচে আছেন আগুনে পোড়া বিকৃত মুখমণ্ডল নিয়ে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সহিংসতায় ওই সময়ে প্রায় ১৮৩ জন আহত হন। আর নিহত হন ২১ জন। শরীরের শতকরা ১ শতাংশ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৫৩ শতাংশ পর্যন্ত পুড়ে যাওয়া রোগীরা সে সময় ভর্তি হয়েছিলেন এখানে।
ওই সময়ের কথা জানতে চাইলে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের প্রকল্প পরিচালক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘পুড়ে যাওয়া এত রোগী একসঙ্গে আমরা আগে কখনও দেখিনি। আমরা চিকিৎসক হলেও ওই দিনগুলো আমাদের জন্যও ছিল বিভীষিকাময়।’
সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘প্রতিদিন রোগী আসত। বার্ন ইউনিটের প্রতিটি ফ্লোরে পেট্রোল বোমায় ঝলসানো রোগী ছিল। তাদের চিৎকার-আহাজারিতে যে পরিবেশ সৃষ্টি হতো সেটা একজন চিকিৎসক হিসেবে আমার জন্য অত্যন্ত বেদনার।’
এসব রোগীদের কাউকে কাউকে সারাজীবন চিকিৎসা নিতে হবে জানিয়ে সামন্ত লাল বলেন, ‘কোনও পরিবারের একজনও যদি অগ্নিদগ্ধ হন তাহলেও এর ভোগান্তি হয় গোটা পরিবারেরই। সারাজীবন তাদেরকে এ ক্ষত বয়ে বেড়াতে হয়। রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না হয়েও সাধারণ মানুষ এই নৃশংসতার শিকার হয়েছে। এমনটি কোনোভাবেই সুস্থ মানুষের কাম্য নয়।’
কমেন্ট