হঠাৎ কেন মোদিকে এরদোগানের সঙ্গে তুলনা করছে ভারতীয়রা

হঠাৎ কেন মোদিকে এরদোগানের সঙ্গে তুলনা করছে ভারতীয়রা

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের জন্য চলতি সপ্তাহটা বলতে গেলে দারুন ছিল। তুরস্কে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে যুক্ত কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে) নিজেদের ভেঙে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরদোগানের আরও ঘনিষ্ঠ হতে থাকা দেশ সিরিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

 

ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে শান্তি আলোচনা তুরস্কতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। নতুন পোপ শিগগিরই সে দেশ সফর করতে চলেছেন বলে ঘোষণা করেছেন। শুধু তাই নয়, তুরস্ক সমর্থিত লিবিয়ার প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা আরও মজবুত হয়েছে। পাশাপাশি ভারতের বিরুদ্ধে সাহায্যের জন্য এরদোগানকে ধন্যবাদ জানিয়েছে পাকিস্তান। খবর বিবিসি বাংলা।

অন্যদিকে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য গত দুই সপ্তাহ ছিল ‘চ্যালেঞ্জিং’। গত ২২ এপ্রিল পেহেলগাম হামলার পর ৬ ও ৭ মে-র মধ্যবর্তী রাতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেয় ভারত। এরপর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়ে এবং হামলা ও পাল্টা হামলা চলতে থাকে।

তারপর দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার সময় তার কৃতিত্ব নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বার্তা যায় যে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ‘নির্দেশ’ দিচ্ছে।


ভারত ও পাকিস্তানের সংঘর্ষে তুরস্ক প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়েছিল। এই আবহে তুরস্ককে নিয়ে ভারতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল বিতর্ক চলছে। আবার ভারত দাবি করেছে পাকিস্তান যেসব ড্রোন হামলা চালিয়েছে যেগুলো তুরস্কে নির্মিত।

এ নিয়ে ভারতীয়দের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুরস্কের বিরুদ্ধে বয়কটের ডাক ওঠে। রাজনৈতিক নেতারাও এর প্রতিধ্বনি তোলেন।

গত বৃহস্পতিবার ভারত জাতীয় নিরাপত্তার উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে তুর্কি সংস্থা চেলেবিকে তাদের বিমানবন্দরে কার্যক্রম পরিচালনা করতে নিষেধ করেছে, যদিও এই অভিযোগ কোম্পানিটি অস্বীকার করেছে।

এছাড়া জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া এবং মাওলানা আজাদ ন্যাশনাল উর্দু ইউনিভার্সিটিসহ বেশ কয়েকটি ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তুর্কি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একাডেমিক সম্পর্ক স্থগিত করেছে। তবে ভারতের এসব সিদ্ধান্তে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ‘বিশেষ ভ্রূক্ষেপ’ নেই বলেই মনে হচ্ছে।

তিনি বৃহস্পতিবার বলেছেন, আমরা পাকিস্তানের জনগণের পাশে আছি। আমি আমার ভাই শাহবাজ শরিফকে ফোন করে বলেছিলাম যে আমরা পাশে আছি। আমরা পাকিস্তানের পাশে থাকব।

দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর ওয়েস্ট এশিয়া স্টাডিজ’-এর অধ্যাপক অশ্বিনী মহাপাত্র মনে করেন, প্রেসিডেন্ট এরদোগানের আত্মবিশ্বাস বাড়ার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে।

অধ্যাপক মহাপাত্র বলেছেন, সিরিয়া ও লিবিয়ায় নিজের পছন্দের সরকার প্রতিষ্ঠা করিয়েছেন এরদোগান। আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে আজারবাইজানকে জিতিয়েছেন। ট্রাম্পও সিরিয়া সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে, তিনি মনে করছেন যে পশ্চিম এশিয়ার মতো দক্ষিণ এশিয়াতেও ইচ্ছেমতো কাজ করে যেতে পারবেন। এরদোগান যেভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন করছেন, তাতে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়বে বৈকি। তার মতে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে সমীকরণ কিন্তু আলাদা।

অধ্যাপক মহাপাত্র বলছেন, তাকে (প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে) বুঝতে হবে যে দক্ষিণ এশিয়া কিন্তু পশ্চিম এশিয়ার মতো নয়। ইসলামের নামে দক্ষিণ এশিয়ার পাকিস্তানের কাছে নিজেকে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারেন এরদোগান, কিন্তু অন্যত্র কোথাও এমনটা হবে না।

তিনি বলছেন, ভারতের উচিত তুরস্কের বিষয়ে কূটনৈতিকভাবে আরও সক্রিয় হওয়া। যেমন, আর্মেনিয়া ও গ্রিসের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করা। সাইপ্রাসের প্রতি সমর্থন বাড়ানো এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও মোকাবিলা করা। তুরস্ক কখনোই ভারতের সঙ্গে ছিল না, কিন্তু এখন এরদোগান ইসলামের নামে ভারতবিরোধী প্রচার চালাচ্ছেন।

প্রধানমন্ত্রী মোদি ও প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ‘তুলনা’

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের মধ্যে প্রায়শই তুলনা করা হয়। দু’জনের রাজনীতি ও ব্যক্তিত্বের বিশ্লেষণে অনেক মিল রয়েছে বলেও মনে করা হয়।

এরদোগান ১৯৯৪ সালে ইস্তাম্বুলের মেয়র হন। ২০০৩ সালে দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন এবং টানা তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালনের পর ২০১৪ সালে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট পদে আসেন।

অন্যদিকে, নরেন্দ্র মোদি ২০০১ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হন এবং ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

মোদি ২০২০ সালের আগস্ট মাসে অযোধ্যায় রাম মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সময় বলেছিলেন শতাব্দীর অপেক্ষার অবসান হয়েছে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ইস্তাম্বুলের আয়া সোফিয়াকে জাদুঘর থেকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন। সময়টা ছিল ২০২০ সালের জুলাই মাস। সেই সময় তাকে বলে শোনা গিয়েছিল, আমাদের যুবসম্প্রদায়ের কাছে এটা একটা বড় স্বপ্ন ছিল যা এখন পূর্ণ হয়েছে।

নরেন্দ্র মোদি হিন্দু জাতীয়তাবাদী হিসেবে বিবেচিত হন এবং রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানকে বিবেচনা করা হয় একজন ইসলামিক ভাবধারার নেতা হিসেবে। এই দুই নেতাকেই সেই রাজনীতির চ্যাম্পিয়ন বলে মনে করা হয়, যে রাজনীতির সঙ্গে ধর্ম অনিবার্যভাবে জড়িয়ে রয়েছে। এরা দু’জনেই ধর্মনিরপেক্ষ দেশের নেতৃত্ব দিলেও তারা চান রাষ্ট্র ও জাতিগতভাবে ধর্মের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান থাকুক।

এরদোগান তুরস্কের নাম পরিবর্তন করে ‘তুর্কিয়ে’ রেখেছেন এবং বিজেপির নরেন্দ্র মোদিও তার দেশের ইন্ডিয়ার নামটির পরিবর্তে ভারত ব্যবহার করতে চান।

মোদি ও এরদোগানের অতীত

প্রবীণ কংগ্রেস নেতা এবং সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শশী থারুর বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে মোদি সরকারের নীতিকে সমর্থন করলেও, ২০১৮ সালে তিনি নরেন্দ্র মোদি ও এরদোগানের মধ্যে ‘সামঞ্জস্যের’ বিষয়ে একটা প্রতিবেদন লিখেছিলেন। ‘প্রজেক্ট সিন্ডিকেট’-এ সেই বছরের ৭ জুন প্রকাশিত হয়েছিল ওই প্রতিবেদন।

সেই প্রতিবেদনে শশী থারুর লিখেছিলেন, মোদি ও এরদোাগন দু’জনেই ছোটো শহরের দরিদ্র অবস্থা থেকে উঠে এসেছেন। তুরস্কের রাইজ শহরে একসময় লেবুর শরবত ও পেস্ট্রি বিক্রি করেছেন এরদোগান। অন্যদিকে, ভাদনগরের রেল স্টেশনে বাবা ও ভাইকে চায়ের দোকান চালাতে সাহায্য করতেন মোদি। তারা দু’জনেই নিজেই নিজের রাস্তা গড়েছেন, উদ্যমী এবং শারীরিকভাবে ফিট। নেতা হওয়ার আগে এরদোগান পেশাদার ফুটবলার ছিলেন, অন্যদিকে মোদি তার ৫৬ ইঞ্চি ছাতি নিয়ে গর্ব বোধ করেন। দুই নেতার মধ্যে অন্য সামঞ্জস্যের কথাও উল্লেখ করেছিলেন শশী থারুর।

তিনি লিখেছেন, এরদোগানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) এবং নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) উভয়ই ধর্মীয় ভাবনাকে উৎসাহ দেয়। দুই দলই জাতীয়তাবাদকে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করে এবং যুক্তি দেয় যে তাদের নিজেদের প্রাচীন ব্যবস্থা পশ্চিমা-অনুপ্রাণিত ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শের চেয়ে ভালো।

তিনি লেখেন, এরদোগান এবং মোদি দু’জনেই অতীতের কথা তুলে ধরেন। এরদোগান উসমানিয় সাম্রাজ্যের প্রশংসা করে তার ভোটারদের বলেন যে আপনারা শুধু একজন প্রেসিডেন্টকেই নির্বাচন করছেন না, দেশের পরবর্তী শতাব্দীর বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। অন্যদিকে মোদি প্রাচীন ভারতের কথা তুলে ধরেন এবং তাকে পুনরুজ্জীবিত করে পুরানো গৌরব ফিরে পেতে চান।

শশী থারুর লিখেছেন, অবশ্যই তুরস্ক ও ভারতের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। তুরস্কের জনসংখ্যা আট কোটি ১০ লাখ, যা ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও কম। তুরস্কে ৯৮ শতাংশ মুসলমান আর ভারতে ৮০ শতাংশ হিন্দু। তুরস্ক কমবেশি একটি উন্নত দেশ এবং সেখানে পৌঁছাতে ভারতকে অনেকটা পথ অতিক্রম করতে হবে। আবার ভারতের মতো তুরস্ক কখনোই উপনিবেশ ছিল না এবং সেখানে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন হয়নি। দেশভাগের পর পাকিস্তান গঠিত হয় এবং এরদোগান সেই পাকিস্তানের পাশেই দাঁড়িয়েছেন।

এরদোগান ও মোদির রাজনীতির তুলনা করে ২০১৭ সালে ‘এ কোয়েশ্চেন অফ অর্ডার: ইন্ডিয়া, টার্কি অ্যান্ড দ্য রিটার্ন অব স্ট্রংম্যান’ নামে একটা বই লিখেছিলেন।

গাজা উপত্যকায় ভোর থেকে ১২৫ ফিলিস্তিনি নিহত পরবর্তী

গাজা উপত্যকায় ভোর থেকে ১২৫ ফিলিস্তিনি নিহত

কমেন্ট